• রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

  • || ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দৈনিক গোপালগঞ্জ

বন্ধুত্বের পরিসর

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন, স্পেন ও ব্রাজিল সফর

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৭ জুলাই ২০২৪  

টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পাশাপাশি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- এই পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, অভিবাসনসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোর উন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি চলতি মাসে প্রথমে চীন, স্পেন এবং ব্রাজিল যাচ্ছেন। এই সফরের মাধ্যমে এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথ রচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে স্পেন ও ব্রাজিলে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর করছেন তিনি। 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কূটনীতিক বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নতুন সরকার গঠনের পর থেকেই সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু কূটনীতিক সম্পর্ক নয়, ইউরোপ ও আমেরিকাতে নতুন বাণিজ্য প্রসার, নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে বৈশ্বিক সহায়তা, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কোটা সুবিধা অব্যাহত রাখা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরগুলোতে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই সফরগুলোতে সেই সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। যেমন গত জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ঠিক চলতি সপ্তাহে চীন সফরকালে প্রায় ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা রয়েছে। স্পেন ও ব্রাজিলের সঙ্গে পৃথক পৃথক সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ স্পেন ও ব্রাজিলে বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় সফর প্রথমবারের মতো হচ্ছে। এই দুই দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার এবং অভিবাসনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জুলাই মাসে এই তিন গুরুত্বপূর্ণ সফরে দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান ও  সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনায় রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও বাড়ানো, অর্থনীতিকে মজবুত করাসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ইস্যুকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। জুলাইয়ের ৮ তারিখে তিনি চীনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। আর স্পেন যাচ্ছেন ২১ জুলাই। স্পেন থেকে ফিরেই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তিনি ব্রাজিল সফর করবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচনে জয়লাভের পরই চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শুভেচ্ছাপত্র এবং চীন সফরের আমন্ত্রণপত্র প্রদান করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা জুন মাসে প্রথমে নয়াদিল্লি সফর করেন। এর পরই বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার চীনে যাচ্ছেন। তার এই সফরে উভয় পক্ষই বেশ কয়েকটি বিষয়ে প্রাধান্য দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ঘিরে উভয় পক্ষই ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। যেহেতু চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার, সেহেতু প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে ঢাকার পক্ষ থেকে উন্নয়ন ইস্যুকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কৃষি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পাবে। এসব খাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে অন্তত ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এই সফরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এই খাতে অন্তত সাত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এই গ্যাস আনার জন্য পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে একশ’ কোটি মার্কিন ডলার। চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি হতে পারে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ সংকট দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তার ঘোষণা দিতে পারে চীন। এদিকে বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ব্যাংক নগদের সঙ্গে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেন যেন আরও সহজ হয়, সে লক্ষ্যে এই চুক্তি সই হচ্ছে।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে একযোগে কাজ করছে। তবে রাখাইনে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই বার্তা দিয়েছে বেজিং। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আরও গভীর করতে চায় দেশটি।

একই সঙ্গে দুই দেশের উন্নয়ন কৌশলগুলোকে আরও একত্রিত, বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার অগ্রগতি, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে গতি বাড়ানো, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন স্তরে উন্নীত করতে চায় বেজিং।
চীন থেকে দেশে ফিরে ২১ জুলাই দ্বিপক্ষীয় সফরে স্পেনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। দেশটির সরকারপ্রধান পেদ্রো সানচেজের আমন্ত্রণে স্পেন সফরে যাচ্ছেন তিনি। এটিই মাদ্রিদে শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। 
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ স্পেনের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ আরও বাড়াতে চায় বাংলাদেশ।

স্পেনেরও এ বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপের মধ্যে স্পেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। এই সফরে অভিবাসন ইস্যুটিও প্রাধান্য পাবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা, শান্তি প্রতিষ্ঠা, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়েও কাজ করতে চায় দুই দেশ।
প্রধানমন্ত্রীর সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ও স্পেনের রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা। এ বিষয়ে একজন কূটনীতিক বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ স্পেন। দেশটির সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো বাংলাদেশের অন্যতম লক্ষ্য। এর মাধ্যমে সমগ্র ইইউতে বাংলাদেশের যে স্বার্থ আছে, সেটি আরও ভালোভাবে রক্ষা করা যাবে।
সবশেষে চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শেখ হাসিনা ব্রাজিল সফরে যাবেন। উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশটির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, কৃষিসহ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে সাত থেকে আটটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। 
শেখ হাসিনার ব্রাজিল সফরে দেশটির সঙ্গে যেমন রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার সুযোগ রয়েছে, তেমনি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা পথ বিস্তৃত হতে পারে। সফরে কৃষি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ আরও কিছু সমঝোতা সই হবে।
এর আগে গত এপ্রিল মাসে ঢাকা সফরে এসেছিলেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা। এটি ছিল দেশটির প্রথম কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর। ওই সফরে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ব্রাজিল সফরের আমন্ত্রণ জানান ভিয়েরা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্রাজিল সফরে রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে পছন্দ করেন। ব্রাজিল বড় অর্থনীতির দেশ এবং ব্রিকসের সদস্য। দেশটির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে এটা একটা ভালো সফর হবে বলে আশা করা যায়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরে ব্রাজিলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া, ওষুধ রপ্তানি, ইথানল আমদানি বা দেশে ইথানল উৎপাদনে সহায়তা, সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও সামুদ্রিক পর্যটনে সহায়তা আলোচ্য সূচিতে থাকতে পারে।
অন্যদিকে, ব্রাসিলিয়া বাংলাদেশে গরুর মাংস রপ্তানি, ইথানল রপ্তানি, তুলার রপ্তানি বাড়ানো, পোলট্রি ও ফিশ ফিড বিক্রি করার বিষয়ে জোর দিতে পারে। এ ছাড়া ব্রিকসে নতুন সদস্য পদ না হোক, অন্তত যে কোনো ফরম্যাটে বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।
গত এপ্রিলে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে দেশটির সঙ্গে কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এই চুক্তি ব্রাজিলের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথ সুগম করেছে। ব্রাজিলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়াতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) অথবা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করতে চায় বাংলাদেশ। পাশাপাশি মার্কোসুরভুক্ত (লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের জোট) দেশগুলোর সঙ্গে পিটিএ চুক্তির ক্ষেত্রে ব্রাজিলের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ।

ব্রাজিল সফরকালে প্রধানমন্ত্রী  গুরত্বসহকারে এসব বিষয় তুলে ধরতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, কোনো দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দ্বিপক্ষীয় সফরগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রীর সফরগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে স্পেন ও ব্রাজিলে তিনি প্রথমবারের মতো দ্বিপক্ষীয় সফরে যাচ্ছেন।

এই সফরের ফলে দুই দেশের সঙ্গে নতুন করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কেরও প্রসার ঘটবে। এ ছাড়া অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার চীনের সফরও বাংলাদেশের জন্য অর্থবহ। মূলত, সরকারপ্রধান এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েই সফর করছেন।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ