• শনিবার ০৬ জুলাই ২০২৪ ||

  • আষাঢ় ২২ ১৪৩১

  • || ২৮ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

দেনমোহর আদায় ও খরচ নিয়ে ইসলাম কী বলে

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩ জুলাই ২০২৪  

নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক। বৈধ ভালোবাসায় এদের সিক্ত হওয়ার একমাত্র হালাল মাধ্যম হচ্ছে বিয়ে, যার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে দেনমোহর। প্রকৃতপক্ষে দেনমোহরও এক প্রকার ঋণ। কেউ যদি তা আদায়ের ইচ্ছা না রাখে, তাহলে হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী সে ব্যক্তিও প্রতারক বা চোর হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই প্রত্যেক মুসলিম পুরুষের উচিত এমন মারাত্মক অপরাধ থেকে বেঁচে থাকা, আর এজন্য দেনমোহর আদায় করে দেয়া। সাধ্যের অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ করে আদায় না করা গুনাহের কাজ।

বিবাহ এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অন্যের কাছে উপকৃত ও পরিতৃপ্ত। কিন্তু স্বামীর অধিকার বেশি। তাই স্ত্রীর কর্তব্য অধিক। স্ত্রী তার দেহ-যৌবন সহ স্বামীর বাড়িতে এসে বা সদা ছায়ার ন্যায় স্বামীর-পাশে থেকে তার অনুসরণ ও সেবা করে। তাই তো এই চুক্তিতে তাকে এমন কিছু পারিতোষিক প্রদান করতে হয় যাতে সে সন্তুষ্ট হয়ে স্বামীর বন্ধনে আসতে রাজী হয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং মানুষকে এ বিধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, 

وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلاَّ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ كِتَابَ اللهِ عَلَيْكُمْ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً

‘‘উল্লিখিত (অবৈধ) নারীগণ ব্যতীত অন্যান্য নারীগণকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তোমাদের স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য, ব্যভিচারের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর অর্পণ করবে।’’

তিনি অন্যত্র বলেন,

وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً

‘‘এবং তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর সন্তুষ্ট মনে দিয়ে দাও।’’

আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন,

إِنَّ أَحَقَّ الشَّرْطِ أَنْ يُوفَى بِهِ مَا اسْتَحْلَلْتُمْ بِهِ الْفُرُوجَ.

‘‘সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যা পূরণ করা জরুরি, তা হল সেই বস্তুত যার দ্বারা তোমরা (স্ত্রীদের) গুপ্তাঙ্গ হালাল করে থাক।’’

সুতরাং স্ত্রীকে তার ঐ প্রদেয় মোহর প্রদান করা ফরজ। জমি, জায়গা, অর্থ, অলংকার, কাপড়চোপড় ইত্যাদি মোহরে দেওয়া চলে। বরং প্রয়োজনে (পাত্রীপক্ষ রাজী হলে) কুরআন শিক্ষাদান, ইসলাম গ্রহণও মোহর হতে পারে।

মোহর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে সেচ্ছায় বেশী দেওয়া নিন্দনীয় নয়। মহানবী (সা.) তার কোনো স্ত্রী ও কন্যার মোহর ৪৮০ দিরহাম (১৪২৮ গ্রাম ওজনের রৌপ্যমুদ্রা) এর অধিক ছিল না। হজরত ফাতেমা (রা.) এর মোহর ছিল একটি লৌহবর্ম। হজরত আয়েশা বলেন, তার মোহর ছিল ৫০০ দিরহাম (১৪৮৭,৫ গ্রাম ওজনের রৌপ্য মুদ্রা)। তবে কেবল উম্মে হাবীবার মোহর ছিল ৪০০০ দিরহাম (১১৯০০ গ্রাম রৌপ্য মুদ্রা)। অবশ্য এই মোহর বাদশাহ নাজাশী মহানবী (সা.) এর তরফ থেকে আদায় করেছিলেন।

তাছাড়া তিনি বলেন, ‘‘নারীর বর্কতের মধ্যে; তাকে পয়গাম দেওয়া সহজ হওয়া, তার মোহর স্বল্প হওয়া এবং তার গর্ভাশয়ে সহজে সন্তান ধরা অন্যতম।’’

হজরত মূসা (আ.) তার প্রদেয় মোহরের বিনিময়ে শ্বশুরের আট অথবা দশ বছর মজুরি করেছিলেন।

মোহর হালকা হলে বিবাহ সহজসাধ্য হবে; এবং সেটাই বাঞ্ছিত। পক্ষান্তরে পণ-প্রথার মত মোহর অতিরিক্ত বেশী চাওয়ার প্রথাও এক কু-প্রথা।

মোহরের অর্থ কেবল স্ত্রীর প্রাপ্য হক; অভিভাবকের নয়। এতে বিবাহের পরে স্বামীরও কোনো অধিকার নেই। স্ত্রী বৈধভাবে যেখানে ইচ্ছা সেখানে খরচ করতে পারে। অবশ্য স্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে স্বেচ্ছায় স্বামীকে দিলে তা উভয়ের জন্য বৈধ। 

আকদের সময় মোহর নির্ধারিত না করলেও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর স্ত্রী সেই মহিলার সমপরিমাণ চলতি মোহরের অধিকারিণী হবে, যে সর্বদিক দিয়ে তারই অনুরূপ। মিলনের পূর্বে স্বামী মারা গেলেও ঐরূপ চলতি মোহর ও মীরাসের হকদার হবে।

মোহর নির্দিষ্ট না করে বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বেই স্বামী তালাক দিলে স্ত্রী মোহরের হকদার হয় না। তবে তাকে সাধ্যমতো অর্থাদি খরচ-পত্র দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।

বিবাহের সময় মোহর নির্ধারিত করে সম্পূর্ণ অথবা কিছু মোহর বাকী রাখা চলে। মিলনের পর স্ত্রী সে ঋণ মওকুফ করে দিতে পারে। নচেৎ ঋণ হয়ে তা স্বামীর ঘাড়ে থেকেই যাবে।

মোহর নির্ধারিত করে বা কিছু আদায়ের পর বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বে স্বামী মারা গেলেও স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। স্ত্রী মারা গেলে স্বামী মোহর ফেরত পাবে না।

মোহর নির্দিষ্ট করে আদায় দিয়ে মিলন করার পর স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে মোহর ফেরত পাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَاراً فَلا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئاً أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَاناً وَإِثْماً مُبِيناً- وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنْكُمْ مِيثَاقاً غَلِيظاً

‘‘আর যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক, তবুও তা থেকে কিছুই গ্রহণ করো না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপাচারণ দ্বারা তা গ্রহণ করবে? কীভাবে তোমরা তা গ্রহণ করবে, অথচ তোমরা পরস্পর সহবাস করেছ এবং তারা তোমাদের কাছ থেকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়েছে?’’

মোহর ধার্য হয়ে আদায় না করে মিলনের পূর্বেই তালাক দিলে নির্দিষ্ট মোহরের অর্ধেক আদায় করতে হবে। অবশ্য যদি স্ত্রী অথবা যার হাতে বিবাহবন্ধন সে (স্বামী) মাফ করে দেয়, তবে সে কথা ভিন্ন। তবে মাফ করে দেওয়াটাই আত্মসংযমের নিকটতর।

মিলনের পূর্বে যদি স্ত্রী নিজের দোষে তালাক পায় অথবা খোলা তালাক নেয়, তবে মোহর তো পাবেই না এবং কোন খরচ-পত্রও না। মোহর আদায় দিয়ে থাকলে মিলনের পরেও যদি স্ত্রী খোলা তালাক চায়, তাহলে স্বামীকে তার ঐ প্রদত্ত মোহর ফেরত দিতে হবে।

কোন অবৈধ বা অগম্যা নারীর সাথে ভুলক্রমে বিবাহ হয়ে মিলনের পর তার অবৈধতা (যেমন গর্ভ আছে বা দুধ বোন হয় ইত্যাদি) জানা গেলে ঐ স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। তবে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ওয়াজেব। একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে সকল স্ত্রীর মোহর সমান হওয়া জরুরি নয়।

স্ত্রীর মোহরের অর্থ খরচ করে ফেলে স্বামী যদি তার বিনিময়ে স্ত্রীকে তার সমপরিমাণ জমি বা জায়গা লিখে দেয় তবে তা বৈধ। পক্ষান্তরে অন্যান্য ওয়ারিশ রাজি না হলে কোন স্ত্রীর নামে (বা কোন ওয়ারেসের নামে) অতিরিক্ত কিছু জায়গাজমি উইল করা বৈধ নয়। কারণ, কোন ওয়ারেসের জন্য অসিয়ত নেই।

পাত্রীর নিকট থেকে ৫০ হাজার (পণ) নিয়ে ১০ বা ২০ হাজার তাকে মোহর দিলে অথবা নামে মাত্র মোহর বাঁধলে এবং আদায়ের নিয়ত না থাকলে অথবা দশ হাজারের দশ টাকা আদায় ও অবশিষ্ট বাকী রেখে আদায়ের নিয়ত না রাখলে; অর্থাৎ স্ত্রীর ঐ প্রাপ্য হক পূর্ণমাত্রায় আদায় দেওয়ার ইচ্ছা না থাকলে এই ধোঁকায় বিবাহ হবে কি না সন্দেহ। অবশ্য এ কাজ যে আল্লাহর ফরজ আইনের বিরুদ্ধাচরণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ