• রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

  • || ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দৈনিক গোপালগঞ্জ

নেক কাজে ‘সেলফি’ ভয়ংকর ফেতনা

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২৪  

একটা সময় ছিল, আমাদের আকাবিরগণ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে অতিরিক্ত কঠোরতার নীতি অবলম্বন করেছিলেন। ফতোয়া দিয়েছিলেন টিভি দেখা যাবে না, মাইক ব্যবহার নিষেধ, অকারণে মোবাইল চালানো ঠিক নয় ইত্যাদি। তখন আমাদের কেউ কেউ এসবের বিরোধিতা করেন। কেউ কেউ হুংকার দিয়ে ওঠেন, আরে! আর কত মুসলমানদের পিছিয়ে রাখবে এই মোল্লারা, আধুনিক এই যুগে প্রযুক্তি ছাড়া কি চলা যায়? আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসাতে শুরু করলাম আমরা। ভাসতে ভাসতে এমন এক ভয়ংকর দ্বীপে এসে পৌঁছেছি, যেখানে সেলফি ছাড়া আর কিছুরই কদর হয় না। দাওয়াতের মেহনতে বের হলে সেলফি, কিতাবের পাতায় ডুবে থাকার সেলফি, নামাজের মুসল্লা, ইফতারের দস্তরখানা, মসজিদের মিম্বর, কোরবানির গরু, দান-খয়রাত থেকে শুরু করে হেন কোনো কাজ নেই যেখানে আমাদের সেলফি ছাড়া চলে না। সেলফির বাড়াবাড়ির কারণে তো হজে সেলফি তোলার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি পর্যন্ত আরোপ করেছে সৌদি সরকার।

আগে আলেমরা ফতোয়া দিয়েছেন, এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মেন্টর সবাই বলা শুরু করেছেন অতিরিক্ত ডিভাইস চালানো ভয়ংকর অসুস্থতা। কথায় কথায় সেলফি তোলা ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। এমনকি এর প্রভাব পড়ছে শারীরিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনেও। আসলে এখনই সময় এসেছে সেলফি নামক ভয়ংকর ফেতনা থেকে জাতিকে সচেতন করার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, একজন নেককার মুসলমান কখনো সেলফির নেশায় পড়তে পারেন না। বিশেষ করে ইবাদত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তো নয়ই। কেননা, ভালো কাজে সেলফি তুলে তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা বহু আগে থেকেই ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিসে এটাকে রিয়া বা লোকদেখানো আমল বলা হয়েছে। আমার নেক কাজ মানুষ দেখবে এতে আমার ভিতর ভালো লাগা কাজ করবে এটাই রিয়া। একটা ভালো কাজ করলাম, কেউ দেখল না, আলোচনা করল না, অমুক খুব ভালো মানুষ, ভালো কাজ করেছে এমন কোনো মন্তব্য কানে এলো না; তাহলে ভালো কাজ করে কী লাভ-এ মানসিকতাই রিয়া।

রিয়া বা লোকদেখানো আমলের ব্যাপারে রসুল (সা.) বলেন, হে সাহাবিরা! আমার উম্মত বড় শিরকে জড়িয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে এ ভয় আমার নেই। আমার ভয় হলো তারা ছোট শিরকে ডুবে দুনিয়া-আখেরাত দুটোই ধ্বংস করে ফেলবে। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! ছোট শিরক কী? রসুল (সা.) বললেন, ছোট শিরক হলো রিয়া। লোকদেখানো আমল। কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা বান্দাকে ডেকে বলবেন, ‘হে বান্দা! দুনিয়ায় যাদের খুশি করার জন্য বা যাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমল করেছে আজ তাদের কাছে যাও, দেখো তারা কোনো প্রতিদান দিতে পারে কি না!’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর ২৩৬২৯)

 

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় একজন গবেষক বলেন, রসুল (সা.) ছোট শিরক বা রিয়াকে কেন দাজ্জাল থেকে ভয়ংকর মনে করলেন? দাজ্জাল বিশেষ একটি সৃষ্টি, নির্দিষ্ট সময় আসবে। সে পৃথিবীতে দেড় বছরও থাকবে না। এ সময় যারা পৃথিবীতে থাকবে, তারাই শুধু তার ফেতনার মুখোমুখি হবে। তাও আবার সে সময়ের সব মানুষ নয়। কিন্তু ছোট শিরক তথা রিয়া ও প্রসিদ্ধি কামনা তো যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে, যে কোনো মুমিনের অন্তরে ঢুকে তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এজন্য রসুল (সা.) একে দাজ্জাল থেকেও বেশি ভয়ংকর বলেছেন। সাহাবি মাহমুদ ইবনে লাবিদ থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘তামরা ছোট শিরক থেকে খুব বেঁচে থাকো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! ছোট শিরক কী? নবীজি বলেন, সেটি হলো, তোমাদের কেউ সুন্দর করে নামাজ পড়ে, আর চায় মানুষ যেন তা দেখে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নম্বর ৮৪৮৯; সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নম্বর ৯৩৭।)

অন্য এক হাদিসে এসেছে, এক দিন রসুলের মজলিশে কয়েকজন সাহাবি ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। রসুল (সা.) বললেন, আমি তোমাদের নিষেধ করেছি মজলিশে পরস্পর কানাঘুষা করবে না। ওই সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আমরা তওবা করছি, আর কখনো এমনটি করব না। আসলে আমরা দাজ্জালের ফেতনার বিষয়ে কথা বলছিলাম। রসুল (সা.) বললেন, আমি কি তোমাদের দাজ্জালের চেয়েও ভয়ংকর ফেতনার কথা বলব না? সেটা হলো নিজেকে দেখিয়ে বেড়ানোর ফেতনা। নিজের আমল, সৌন্দর্য অন্যকে দেখানো এবং এর ফলে নিজের মনে আনন্দ পাওয়ার ফেতনা থেকে তোমরা বেঁচে থাক। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর ১১২৫২)

নবীজি (সা.) অন্য একটি হাদিসে বলেন, ‘সম্পদের লোভ আর মানুষের চোখে ভালো হওয়া অর্থাৎ মর্যাদা পাওয়ার লোভ, একজন মুমিনের দীনকে যেভাবে ধ্বংস করে, দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েও একটি বকরির পালকে তত ধ্বংস করতে পারে না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর ১৫৭৮৪)। দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে যদি একটি বকরির পালে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে পুরো পাল যে শেষ করে দেবে, জানা কথা। নবীজি বলেন, সম্পদের লোভ ও মর্যাদার লোভ মানুষের দীনকে এর চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করে। হায়! নেকড়ে থেকে পালানোর জন্য মানুষ প্রাণপণ চেষ্টা করে, কিন্তু আমরা সেলফি নামক নেকড়ে কোলে তুলে নিচ্ছি এবং মনের ভিতর পুষছি। তাই যা হওয়ার হচ্ছে; আমাদের আমল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ